ইউক্রেন, বেলারুস ও রাশিয়ার যে বৈঠকে ভেঙে গিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন

 

বৈঠকের পর ইউক্রেনের নেতা লিওনিদ ক্রাভচুক (বামে), বেলারুসের স্তানিস্লাভ শুশকেভিচ (মাঝখানে) এবং রাশিয়ার নেতা বরিস ইয়েলৎসিন ডানে)।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,

বৈঠকের পর ইউক্রেনের নেতা লিওনিদ ক্রাভচুক (বামে), বেলারুসের স্তানিস্লাভ শুশকেভিচ (মাঝখানে) এবং রাশিয়ার নেতা বরিস ইয়েলৎসিন (ডানে)।

সোভিয়েত ইউনিয়নের তিনটি প্রজাতন্ত্র- রাশিয়া, ইউক্রেন এবং বেলারুসের নেতারা সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য গোপনে একটি চুক্তিতে সই করেছিলেন ১৯৯১ সালের ডিসেম্বর মাসে। বাকি প্রজাতন্ত্রগুলোকে কিছু না জানিয়েই তারা এটি করেছিলেন।

চুক্তিটি হওয়ার পর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচভ পদত্যাগ করেন এবং তার জের ধরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।

সেসময় কঠিন সময় পার করছিলেন মিখাইল গর্বাচভ। ততদিনে পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্র ভেঙে পড়েছে। ১৯৮৯ সালে পতন হয়ে গেছে বার্লিন প্রাচীরের। কিন্তু তখনও পর্যন্ত টিকে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন যার নেতৃত্বে ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মিখাইল গর্বাচভ।

কট্টরপন্থী কমিউনিস্টরা ১৯৯১ সালের অগাস্ট মাসে গর্বাচভের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের চেষ্টা চালায়। তারা গর্বাচভের গৃহীত উদারপন্থী কর্মসূচি 'গ্লাসনস্ত পেরস্ত্রইকার' ব্যাপারে খুশি ছিলেন না।

সেই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় গর্বাচভ বেঁচে গেলেন ঠিকই, কিন্তু নতুন এক সমস্যার মুখোমুখি হলেন। কারণ ইউক্রেনসহ সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৫টি প্রজাতন্ত্রের অনেকগুলোতেই এর মধ্যে স্বাধীনতার দাবী জোরালো হয়ে উঠেছে।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট লিওনিদ ক্রাভচুক তখন পথ খুঁজছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে। তিনি বলেন, সেসময় স্বাধীন ইউক্রেন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তার প্রধান অগ্রাধিকার।

ইউক্রেনের নেতা লিওনিদ ক্রাভচুক।

ছবির উৎস,FUTURE PUBLISHING

ছবির ক্যাপশান,

ইউক্রেনের নেতা লিওনিদ ক্রাভচুক বলেছেন, স্বাধীন ইউক্রেন ছিল তার অগ্রাধিকার।

বৈঠকের উদ্দেশ্য

ইউক্রেন, বেলারুস এবং রাশিয়া- এই তিনটি প্রজাতন্ত্রের নেতারা বৈঠকে বসেন ১৯৯১ সালের ডিসেম্বর মাসে। এই বৈঠকের জের ধরেই আকস্মিকভাবে পতন ঘটে সোভিয়েত ইউনিয়নের।

বৈঠকটি হয়েছিল পশ্চিম বেলারুসে। ডেকেছিলেন বেলারুসের প্রেসিডেন্ট স্তানিস্লাভ শুশকেভিচ। তার সঙ্গে যোগ দেন রাশিয়ার নেতা বরিস ইয়েলৎসিন এবং ইউক্রেনের লিওনিদ ক্রাভচুক।

ইউক্রেন ততদিনে স্বাধীনতার আকাঙ্খার কথা ঘোষণা করে ফেলেছে। কিন্তু বেলারুস তখনও সেরকম কিছু করেনি। বেলারুসের প্রেসিডেন্ট স্তানিস্লাভ শুশকেভিচ বলেছেন বৈঠকে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে তার মনে এরকম কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও ছিল না।

তিনি চেয়েছিলেন শীতকালে বেলারুসে কীভাবে তেল এবং গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করতে।

"আমাদের অর্থনীতি তখন বড় ধরনের সংকটে।। আমরা জ্বালানির মূল্য পরিশোধ করতে পারছিলাম না। কেউ ঋণও দিতে চাইছিল না। আমাদের সাহায্য করার জন্য রাশিয়াকে অনুরোধ করতে যাচ্ছিলাম, যাতে শীতে আমাদের জমে যেতে না হয়," বলেন তিনি।

কিন্তু ইউক্রেনের নেতা লিওনিদ ক্রাভচুক বলেছেন সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত করার পথ খোঁজাই ছিল ওই বৈঠকের একমাত্র আলোচ্য বিষয়।

ক্রাভচুক বলেন শুশকেভিচ যখন তেল ও গ্যাসের কথা বলছিলেন, তখন তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না শুশকেভিচ কী বলছেন!

"আমি ভেবেছিলাম সোভিয়েত ইউনিয়নের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার জন্যই আমরা সেখানে গিয়েছিলাম। কারণ সংকটের কারণে দেশের মানুষ তখন বিপর্যস্ত। দেশটি কোন দিকে যাচ্ছে তা নিয়ে আলোচনার জন্যই আমরা ওই বৈঠকে বসেছিলাম।"

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতাকা।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতাকা।

বৈঠকের পূর্ব নির্ধারিত আলোচ্য-সূচি যাই হোক না কেন, রাশিয়ার নেতা বরিস ইয়েলৎসিনসহ তারা তিনজনই জানতেন মিখাইল গর্বাচভকে না জানিয়ে এরকম একটা বৈঠকে বসা কতোটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।

বেলারুসের নেতা শুশকেভিচ বলেন, "মিখাইল গর্বাচভের নির্দেশে সোভিয়েত গুপ্তচর সংস্থা কেজিবির গোয়েন্দারা আমাদের গ্রেফতার করতে পারতো। কারণ সোভিয়েত কেজিবি তখনও গর্বাচভের অধীনে। কিন্তু আমাদের বেলারুসের গুপ্তচর সংস্থার প্রধান বরিস ইয়েলৎসিনের গুপ্তচর সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন।"

"বৈঠকের প্রায় পনের দিন আগে থেকে প্রতিদিন তিনি আমাকে আশ্বস্ত করেছেন যে গ্রেফতার হওয়ার কোন ঝুঁকি নেই। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বেলারুসের গুপ্তচর সংস্থার প্রধান অবসর নেওয়ার পরে যখন রাশিয়ায় গিয়ে বসবাস করতে শুরু করলেন, তখন তিনি অনুতাপ করেছেন, কেন তিনি ১৯৯১ সালে আমাদের গ্রেফতার করেন নি," হাসতে হাসতে বলেন তিনি।

মদের আসরেই এই সিদ্ধান্ত?

রাশিয়ার নেতা বরিস ইয়েলৎসিন, ইউক্রেনের নেতা লিওনিদ ক্রাভচুক এবং বেলারুসের নেতা স্তানিস্লাভ শুশকেভিচ ১৯৯১ সালের ৭ই ডিসেম্বর বৈঠকে বসেন।

শুশকেভিচ বলেন, "এটা ছিল বিলাসবহুল বাড়ি। সোভিয়েত ইউনিয়নের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের জন্য এটি তৈরি করা হয়েছিল। এ ধরনের বৈঠকে সাধারণত যেরকম হয়, সেখানে স্টিম বাথেরও ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। সাধারণত এই স্টিম বাথের পর, প্রচুর মদ্য পানের আয়োজন করা হয়। তবে এবারের বৈঠকে দেখা গেল, মদ পানের পরিবর্তে মাসাজ বা শরীর মালিশ করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।"

রাশিয়ার বরিস ইয়েলৎসিন।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,

রাশিয়ার বরিস ইয়েলৎসিন। বৈঠকের নেপথ্যে ছিলেন তিনি।

এর পরের দিন ৮ই ডিসেম্বর সকাল ন'টায় এই তিন নেতা তাদের প্রধানমন্ত্রীদের নিয়ে আলোচনায় বসেন। বেলারুসের নেতা স্তানিস্লাভ শুশকেভিচ জানালেন যে বৈঠক শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির ব্যাপারে সমঝোতার প্রথম পরিচ্ছদটি লিখতে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পেরেছিলেন।

"আমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই লাইনটি আমি মনে রাখবো। এটি ছিল আমাদের সমঝোতার শুরুর লাইন। কোন ধরনের তর্কাতর্কি ছাড়াই এই লাইনটির ব্যাপারে আমরা একমত হয়েছিলাম। লাইনটি ছিল এরকম: ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা এবং আন্তর্জাতিক আইনের বিষয় হিসেবে ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকস বা ইউএসএসআর-এর কোন অস্তিত্ব আর নেই।"

লাইনটি শোনার পর বেলারুসের নেতা শুশকেভিচ প্রথম বলেছিলেন যে এতে সবার আগে সই করতে চান।

প্রাসঙ্গিক আরো খবর

এই চুক্তির ফলে সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচভ কার্যত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেলেন। তখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিনের হাতে আরো কিছু ক্ষমতা তুলে দেওয়া হলো।

এর মধ্য দিয়ে কয়েক শতাব্দীর রুশ সাম্রাজ্য এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের অবসান ঘটলো। এটা ছিল বিরাট এক পদক্ষেপ। এর পরে অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছিল যে, এই তিন নেতা সুস্থ মস্তিষ্কে এই চুক্তিতে করেছিলেন কি না।

ইউক্রেনের নেতা লিওনিদ ক্রাভচুক বলেন, "এরকম একটা জনপ্রিয় কল্পকাহিনী প্রচলিত আছে যে আমরা মদ্যপ অবস্থায় এই চুক্তির খসড়া তৈরি করেছিলাম। এটা পুরোপুরি ভুল।"

"এটা ঠিক যে সোভিয়েত রীতিতেই ঐ বৈঠকটির আয়োজন করা হয়েছিল এবং ঐ বাড়ির সবখানেই প্রচুর মদ পানের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু কেউ তা স্পর্শ করেনি। আমরা এক একটা অনুচ্ছেদ তৈরির পর বড়জোর এক-দুই ফোঁটা ব্র্যান্ডি পান করতাম," বলেন তিনি।

বেলারুসের নেতা স্তানিস্লাভ শুশকেভিচ।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,

বেলারুসের নেতা স্তানিস্লাভ শুশকেভিচ। বৈঠকটি ডেকেছিলেন তিনি।

দুনিয়া কাঁপানো ঘটনা

এর পরের কয়েক ঘন্টায় চুক্তির মোট ১৪টি অনুচ্ছেদ গৃহীত হয়। রাত তিনটে নাগাদ তৈরি হয়ে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি ঘোষণার কাগজপত্র। তখন পুরো বিশ্বকে সেটা জানানোর পালা।

বেলারুসের নেতা শুশকেভিচ বলেন, "ইয়েলৎসিন এবং ক্রাভচুক কৌতুক করে আমাকে বললেন, আমরা দু'জন মিলে আপনাকে মনোনীত করেছি গর্বাচভকে বিষয়টি জানানোর জন্য। তখন আমি হেসে বললাম, মিস্টার ইয়েলৎসিন, আমি আর ক্রাভচুক মিলে আপনাকে মনোনীত করছি আপনার প্রিয় বন্ধু প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশকে ফোন করার জন্য।"

মন্তব্যসমূহ